মাঠপ্রশাসনে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ সামলানো ছাড়াও নানা অনিয়ম, চোরাচালানি বা মাদককারবারিদের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রায়ই ঝুঁকিতে পড়তে হয়। অথচ মাঠপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এসব কর্মকর্তা সরকারিভাবে কোনো নিরাপত্তা পান না। ফলে ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তাদের কাজ করতে হয়।
এই ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ইউএনওদের সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত ও বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্দেশনাটি পৌনে তিন বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।
গত বুধবার দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পর সরকারি এই কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। তবে শুধু ইউএনও নয়, জনগণকে সেবাদানকারী সব কর্মকর্তাকেই নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে বলে মনে করেন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান আমাদের সময়কে বলেন, শুধু কর্মকর্তারা নন, দেশের সব নাগরিকই নিরাপত্তা লাভের অধিকার রাখে। প্রশাসনের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, পুলিশ, ব্যাংকার বা সাংবাদিক সবারই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
জরুরি। কিন্তু সবার পেছনেই সরকার চাইলে ১০ জন করে আনসার বা পুুলিশ সদস্য মোতায়েন করতে পারবে না। কর্মকর্তাসহ দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, পুলিশের ভাষ্যমতে ইউএনও ওয়াহিদাকে আঘাতকারী ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের নেতা। সে একজন মাদক চোরাচালানি ও মাদক সেবক। তার নামে মাদক মামলা আছে। অথচ সে বাইরে। তার তো জেলে থাকার কথা। সে কীভাবে বাইরে ঘোরাঘুরি করে। এসব অপরাধী যখন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন কেউ আর নিরাপদ নয়। সুতরাং শুধু ইউএনওদের জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করলেই নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, অপরাধীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আইনের শাসন শতভাগ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য অবশ্যই সরকারকে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ইউএনও ওয়াহিদাকে হত্যাচেষ্টার পর গত বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় রংপুর বিভাগের আট জেলার ৫৮ ইউএনওর সরকারি বাসভবনে আনসার নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালককে চিঠি দেয় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী রংপুর কার্যালয়। চিঠিতে ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিটি উপজেলায় একজন পিসি (প্লাটুন কমান্ডার), একজন এপিসি (সহকারী প্লাটুন কমান্ডার) ও ৮ জন আনসারসহ মোট ১০ জন সশস্ত্র অঙ্গীভূত আনসার সদস্য মোতায়েনের কথা বলা হয়।
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও গণমাধ্যমকে জানান, ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাসভবনে সশস্ত্র আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম দফায় রংপুর বিভাগের আট জেলার ৫৮ ইউএনওর সরকারি বাসভবনে ১০ জন করে আনসার নিয়োগ দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় আনসার নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও এদিন বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ইউএনওদের সরকারি বাসভবনে পাহারায় আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য নিয়োগ করা হবে।
গতকাল শুক্রবার কয়েকটি উপজেলার ইউএনওর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘোড়াঘাটের ইউএনওর ওপর হামলার পর তাদের বাসায় পালাক্রমে চারজন করে আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আগে কখনই তাদের নিরাপত্তায় আনসার সদস্য ছিল না। কতটি উপজেলায় আনসার মোতায়েন করা হয়েছে, সেটি জানার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মিজানুর রহমান শামীমকে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ইউএনও মোহাম্মদ রেজাউল করিম আমাদের সময়কে বলেন, শুক্রবার থেকেই চারজন আনসার সদস্য আমার বাসায় দায়িত্ব পালন করছেন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো একটি চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ লিখেছিল, মাঠপ্রশাসনে ইউএনওরা প্রায় নিরাপত্তাহীন অবস্থায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এর বাইরেও তারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ইউএনওদের পূর্বসূরি মহকুমা প্রশাসকদের (সাব ডিভিশনাল অফিস- এসডিও) গানম্যান ও বাসার জন্য হাউস গার্ডের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এসডিও পদটি বিলুপ্তির পর এই সুবিধাটি ইউএনওদের জন্য কার্যকর করা হয়নি। গুরুত্বসহ প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুশাসন আমলে নিলে হয়তো ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদাকে আজ করুণ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। তারা দ্রুত ইউএনওসহ মাঠপ্রশাসনে কর্মরত সব কর্মকর্তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
এদিকে ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের কেউ কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, ইউএনওদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেটা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। ইউএনওদের নিরাপত্তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি।
Leave a Reply